যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গোপন চুক্তি প্রকাশ: বাণিজ্য উপদেষ্টার আশ্বাস দেশের স্বার্থ রক্ষায়
সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের করা গোপন বাণিজ্য চুক্তি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। একদম স্পষ্ট করে তিনি বলেন, চুক্তিটি দেশের স্বার্থবিরোধী নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতেই তা প্রকাশিত হবে।
গোপনীয়তা ও দেশের স্বার্থ: কেন নন-ডিসক্লোজার চুক্তি?
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানালেন, গোপন চুক্তিতে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো উপাদান থাকলে তাদের সেভাবে এগোবার সুযোগ নেই। দেশের স্বার্থকে কখনোই ক্ষুণ্ণ করতে চাওয়া হয়নি, এমন চুক্তিতে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে দেশের বাণিজ্য সক্ষমতা বা অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তা মানা হবে না।
তিনি আরও বললেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়িক চুক্তিতেও গোপনীয়তার প্রয়োজন হয়। এমনকি দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পদ হস্তান্তরের সময়ও গোপনীয়তার চুক্তি থাকে যাতে বাইরের কারও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ না হয়। তাই গোপনীয়তা থাকা স্বাভাবিক এবং এতে দেশের স্বার্থের প্রতি হানিকর কিছু নেই।
চুক্তি প্রকাশের প্রক্রিয়া
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিটি সই হওয়ার পর দুই দেশ যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করবে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি নিয়ে এই গোপনীয় চুক্তি প্রকাশ করা হবে। তিনি বিশ্বাস করেন, গোপনীয়তার কারণে চুক্তিতে কোনো স্বার্থবিরোধী বিষয় নেই, বরং বিষয়গুলো সযত্নে আলোচনা করে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে।
পালটা শুল্ক কমানোর পেছনের কারণ ও আলোচনার দিকনির্দেশনা
চুক্তি স্বাক্ষরের আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ পালটা শুল্ক আরোপ করা হয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, পালটা শুল্ক কমানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে তিন দফা আলোচনা হয়েছে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বাণিজ্য সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই বাণিজ্য চুক্তি করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানির মাধ্যমে দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য সস্তা ও স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বোয়িংয়ের ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার বিতর্ক
চুক্তি নিয়ে সমালোচনার এক বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, উড়োজাহাজ কেনার বিষয়টি নেগোসিয়েশনের সময় গুরুত্ব পায়নি এবং বোয়িং এখনও মাত্র ১২টি উড়োজাহাজ তৈরি করতে পেরেছে। প্রথমটি সরবরাহ সম্ভব ২০৩৭ সালের আগে নয়। তাই বোয়িং বিক্রির উদ্দেশ্য বাণিজ্য নেগোসিয়েশনের মূল কেন্দ্র ছিল না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়ানোই মূল লক্ষ্য।
তিনি বলেন, বিমান পরিচালনায় সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের যাত্রীদের সংখ্যার তুলনায় বিমানের সংখ্যা কম, ফলে বাজার অনেকটাই হাতছাড়া হচ্ছে। তাই ২৫টি উড়োজাহাজ আসা মোটেও কম নয়, কিন্তু শুধু বিমান কেনা নয়, পরিচালনার সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি। এজন্য আইন ও নীতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
You also like: শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট, র্যাঙ্কিংয়ে টানা উন্নতি
বাংলাদেশের বাণিজ্য উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাশ্রয়ী দামে খাদ্যপণ্য আমদানি করলে দেশের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে এবং ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম যুক্তিসঙ্গত থাকবে। এটি দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণেও সাহায্য করবে।
তুলা, ভুট্টা, সয়াবিন, গম ও এলএনজি আমদানির মাধ্যমে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য বেসরকারি খাতকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। শুল্ক কমানোর সফলতা নির্ভর করবে রপ্তানিকারকদের সক্ষমতার ওপর। তাই এখনই সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না, নিজেদের প্রতিযোগিতা ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যার কারণে দুই দেশের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাণিজ্যের গতিশীলতার কারণে পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল, তাই পালটা শুল্ক কমানো একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এর ফলাফল ভালো রাখতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারীদের সক্ষমতা ও প্রস্তুতি জরুরি।
উপসংহার: স্বচ্ছতা ও স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি
গোপনীয়তা নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশের স্বার্থকে কখনোই ঝুঁকিতে ফেলা হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনায় স্বচ্ছতা ও পারস্পরিক সম্মানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা চলছে। চলতি সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে বিবেচিত হবে।
পরবর্তী সময়ে চুক্তি প্রকাশিত হলে তা দেশের জন্য কী প্রভাব ফেলবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে এ মুহূর্তে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা আশাবাদী, দেশের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়েছে বলে।